সবারই একটা শুরুর গল্প থাকে। শুরুটা যেমনই হোক মেধা খাটিয়ে লক্ষ্যে অবিচল থেকে কেউ কেউ পৌঁছে যান সাফল্যের শিখরে। নইলে গাড়ি ধোয়ার কাজ, ঘোড়সওয়ারের প্রশিক্ষক কিংবা থালাবাসন মাজিয়ের কাজ দিয়ে জীবন শুরু করেও তাঁরা নোবেল পুরস্কারের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্জন করতে পারতেন না। জীবনের প্রথম চাকরির স্মৃতিচারণা করে কয়েকজন মার্কিন নোবেল বিজয়ী জানিয়েছেন, জীবন থেকে কী অদ্ভুত শিক্ষা পেয়ে তাঁরা সাফল্যের পথে হেঁটেছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স তিন নোবেল বিজয়ীর এই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে।
ইউজিন ফামা: গাড়ি ধোয়া-স্টিল মিলের শ্রমিক থেকে নোবেলজয়ী
অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউজিন ফামার পেশাজীবন শুরু হয়েছিল গাড়ি ধোয়ার কাজ দিয়ে। তিনি নিজের জবানেই জানিয়েছেন সেই গল্প: ‘আমার বয়স তখন ১৪, বেড়ে উঠছিলাম বোস্টনের দরিদ্র এক এলাকায়। রাস্তার ওপারেই একজনের গাড়ি ধোয়ার দোকান ছিল। স্কুলজীবনের ওই সময়ে আমি শনিবারগুলোয় সেখানে কাজ করতাম। মনে আছে, ওই দিনগুলো অনেক দীর্ঘ মনে হতো।’
ফামা জানিয়েছেন, ১৩৫৩ সালের দিকে ঘণ্টায় এক ডলারেরও কম টাকার বিনিময়ে ওই গাড়ি ধোয়ার কাজ করতে হতো তাঁকে। সে সময়ে গাড়ি ধোয়ার দোকানগুলোয় এত মেশিনপত্তর না থাকায় খালি হাতেই পানি ঢালা থেকে সবকিছু পরিষ্কারের কাজ করতে হতো ফামা ও তাঁর সহকর্মীদের। পরবর্তী সময়ে মেয়েদের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করেছেন ফামা। কাজ করেছেন স্টিল মিলের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশেও। ফামা বলছেন, ‘এসব কাজ থেকে আমি যা শিখেছি তা হলো, আমার ভালো শিক্ষা প্রয়োজন।’ আর এটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
ক্যারল গ্রাইডার: ঘোড়সওয়ারের প্রশিক্ষক থেকে নোবেলজয়ী
চিকিত্সায় নোবেল বিজয়ী জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারল গ্রাইডারের জীবনের প্রথম চাকরি ছিল ঘোড়সওয়ারের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করা। পেশাজীবনের শুরুর গল্প নিয়ে গ্রাইডার জানিয়েছেন:
‘ক্যালিফোর্নিয়ার ডাভিসে হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালে অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম আমি। থালাবাসন মাজা থেকে আইসক্রিমের দোকানির কাজ—সবকিছুই করতে চেয়েছি আমি। সবাই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমার মনে আছে, জীবনবৃত্তান্তের ছাপা কাগজটা দিয়ে ফুটপাতে চাবকাতে চাবকাতে আমি চিত্কার করছিলাম।
‘শেষ পর্যন্ত আমার জায়গা হয়েছিল হ্যাপি হর্স রাইডিং স্কুলে। শহর থেকে ৩০ মিনিটের পথ দূরে ছিল ওই ঘোড়সওয়ারদের স্কুলটা। ছয় বছর বয়স থেকেই ওই স্কুলে ঘোড়সওয়ারগিরি শিখেছিলাম আমি। ফলে, তাঁরা মনে করেছিল যে আমি প্রশিক্ষক হিসেবে ভালো হব। সেখানে আমি ভল্টিং নামের একটা কোর্স নিতাম, যা মূলত ঘোড়ার পিঠে জিমন্যাস্টিকসের মতো একটা বিষয়।’
১৯৭৬ সালের দিকে ওই প্রশিক্ষণ স্কুলটিতে কাজ করে ঘণ্টায় ছয় ডলারের মতো উপার্জন করতেন গ্রাইডার। ১৭ বছর বয়সে ওই স্কুলের একটা কোর্সের প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্ব ছিল তাঁর। গ্রাইডার মনে করেন, ঘোড়সওয়ারের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে নেতৃত্বের গুণাবলি শিখতে পেরেছিলেন তিনি।
ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড: থালাবাসন মাজিয়ে, পত্রিকার হকার থেকে নোবেলজয়ী
২০১২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজির ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড জীবনের শুরুর দিকে অর্থ উপার্জনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন থালাবাসন মাজার এবং পত্রিকা বিলি করার হকারগিরির কাজ। স্মৃতিচারণায় ওয়াইনল্যান্ড বলেছেন:
‘১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে সাক্রামেন্টো বি পত্রিকা বিলি করার কাজ আমার জীবনের সেরা চাকরিগুলোর একটা। আমি দুটি রুটে পত্রিকা বিলি করতাম। আমার ছোট্ট বাইসাইকেলে চড়েই ঘুরে ঘুরে কয়েক শ পত্রিকা বিলি করতাম আমি। আমি যখন এই কাজ শুরু করি, তখন আমার বয়স মাত্র ১০ বছর।
‘জীবনের সবচেয়ে বাজে চাকরিটাও আমি সে সময়েই করি, একটা বিপণিবিতানের খাবারের দোকানে থালাবাসন মাজিয়ে হিসেবে। ঘণ্টায় সোয়া ডলার বেতন পেতাম সেখানে। এই কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাকে কলেজে পড়তে হবে, যাতে আমি একটা ভালো চাকরি পাই। আমার শিক্ষা হয়েছিল যে সারা জীবন কম বেতনে কাজ করা যাবে না।’
ওয়াইনল্যান্ড জানিয়েছেন, মা-বাবা মার্কিন অর্থনীতির মন্দার শিকার হওয়ার কারণেই এত ছোটোবেলা থেকে কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে।
-প্রথম আলো অবলম্বনে