লাথা জিশনুঃ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের বিমান হামলার দৃশ্যের পাশাপাশি আরও একটি দৃশ্য সবার মনে গেঁথে আছে। ওই সময় ফ্লোরিডায় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ একটি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ছিলেন। বাচ্চারা তাঁকে বই থেকে একটি গল্প পড়ে শোনাচ্ছিল। এমন সময় বুশের চিফ অব স্টাফ শ্রেণিকক্ষে ঢুকে তাঁর কানে কানে জানালেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে দ্বিতীয় প্লেনটি এসে আঘাত হেনেছে।
বুশ এরপর আরও সাত মিনিট শ্রেণিকক্ষে ছিলেন এবং বাচ্চাদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলছিলেন। পরে সেখান থেকে উঠে পাশের রুমে তিনি সংবাদ সম্মেলনে গেলেন। হামলার কথা শোনার পরও সাত মিনিট তাঁর শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। অনেকেই বলেছিলেন, দেশ যখন হামলার মুখে পড়েছে, তখন সে খবর শোনার পরও বুশ নির্বিকারভাবে ‘দীর্ঘ সময়’ বাচ্চাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। এই যুক্তিতে তাঁকে অভিশংসন করা উচিত বলেও তখন সমালোচকেরা মন্তব্য করেছিলেন।
পুলওয়ামার সিআরপিএফ কনভয়ে সন্ত্রাসী হামলায় আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হওয়ার পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কী করছিলেন, তা নিয়ে একইভাবে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সে প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি। কংগ্রেস বলেছে, মোদিকে যখন হামলার খবর দেওয়া হয়, তখন তিনি জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে তাঁকে নিয়ে প্রচারণামূলক একটি ছবির শুটিং করায় ব্যস্ত ছিলেন। খবর শোনার পরও তিনি চার ঘণ্টা ধরে শুটিং করেছেন। তবে সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের এই দাবি সত্য নয়, সেখানে তিনি দাপ্তরিক আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
ভারতবর্ষে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে কাদা-ছোড়াছুড়ি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা নতুন কিছু নয়। কিন্তু পুলওয়ামা হামলার জের ধরে যেভাবে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তা নজিরবিহীন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাগাতার ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাশ্মীরের কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি না করার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
মোদি সরকারের পক্ষের টিভি চ্যানেলগুলো আগে থেকেই জম্মু কাশ্মীর ও এখানকার লোকদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় মত্ত ছিল। এবার তারা কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে একযোগে প্রচার চালাচ্ছে। পুলওয়ামা-কাণ্ডের পর আরএসএসের ছাত্রসংগঠন এবিভিপি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মেঘালয়ের রাজ্যপাল কাশ্মীরের সব পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। কাশ্মীরের লোকদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। একটি রাজ্যের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া কতখানি ধৃষ্টতা, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেন এসব অশুভ বিষয় সমর্থন করে যাচ্ছে? যে কাশ্মীরি জনগণ নিজেদের ভারতীয় বলে মনে করে, তাদের ঘৃণা করে পর করে দেওয়ার এই চক্রান্ত সরকারের উচ্চ মহল কেন প্রশ্রয় দেয়? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাশ্মীরিরা অন্য রাজ্যগুলোতে নিজেদের অরক্ষিত মনে করে আসছে। কেরালার মতো অল্প কয়েকটি রাজ্য ছাড়া অন্য রাজ্যগুলোতে তারা নিরাপদ বোধ করে না। পুলওয়ামার ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব কাশ্মীরের নাগরিকদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এ রাজ্যগুলোতে বিজেপি ক্ষমতায় নেই।
আদিল আহমদ দার নামক ২০ বছর বয়সী যে কাশ্মীরি যুবক পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলা চালালেন, তিনি পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে জড়িত বলে বলা হচ্ছে। এই আদিল আহমদ দার কাশ্মীরের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন না। আদিলের মতো অল্পসংখ্যক কাশ্মীরি এই ধরনের সন্ত্রাসী মানসিকতা পোষণ করে। তার জন্য পুরো কাশ্মীরবাসীকে ঘৃণার চোখে দেখার মতো ধ্বংসাত্মক বিষয় আর কী হতে পারে?
বিজেপিকে মনে রাখতে হবে, তারা ক্ষমতায় আসার আগে কাশ্মীর তুলনামূলকভাবে অনেক শান্ত ছিল। ২০১৬ সালে কাশ্মীরে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর বন্দুকের প্যালেট ছুড়ে বহু তরুণকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষোভকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কাজে লাগাবে, তাতে সন্দেহ নেই। আর তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে আদিলের মতো অল্প বয়সী তরুণদের, যাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞান নেই।
এই রাজনৈতিক সত্যটি বিজেপিকে বুঝতে হবে। বিজেপিকে বুঝতে হবে কাশ্মীরিদের হৃদয় জয় করেই কাশ্মীরকে শাসন করতে হবে। ঘৃণায় কোনো সমাধান নেই।
লাথা জিশনু দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক
প্রথম আলোর সৌজন্যে ডন থেকে অনূদিত