Uncategorized

দ্য ডিসট্যান্ট নিয়ার


মাসিদ রণ (আল-মাসিদ)

বাংলাদেশের তথা ঢাকাই নাট্যচর্চার ঢং মোটা দাগে বলতে গেলে গ্রুপ থিয়েটারকেন্দ্রিক। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে। একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে থিয়েটারের মতো একটি অবাণিজ্যিক শিল্পের প্রসার বা প্রচার যাই বলি, এগুলো পেতে একটি নির্ভরযোগ্য ব্যানার, দল বা সংগঠন লাগে। কিন্তু যুগের পরিবর্তন আর কালের হাওয়া তো শুধু উন্নত দেশের আবহাওয়াতেই ঘুরপাক খাবে, তা তো নয়। এ জন্য এ সময় বিবর্তন বা আধুনিক ব্যস্ত সমাজের বিরাট কলেবরে একটি বাঁক নিতে দেখা গেছে। যে বিষয়টির সংক্রমণ থিয়েটার চর্চায়ও পড়েছে। এ জন্য কিছু আধুনিক মননের মানুষ বাংলার চিরাচরিত থিয়েটার ঢংকে এককথায় ল্যাং মেরে গড়ে তুলেছেন থিয়েটারের নবতর ঢং ‘রেপার্টরি’। এতে যেসব সদস্য কাজ করবেন, তাঁরা কাজের বিনিময়ে কিছু আর্থিক সম্মানীও পাবেন। এ জন্য বর্তমান স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যুগে যাঁরা এর কল্যাণে নিজেকে অভিনয়ে মহাব্যস্ত রেখেছেন, তাঁরা চাইলেই আগ্রহ দেখাতে পারছেন থিয়েটারে অভিনয়ের ব্যাপারে। এর কিছু উদাহরণও আমাদের এখানে তৈরি হয়ে গেছে।

সে যা-ই হোক, ঢাকাই মঞ্চের রেপার্টরি থিয়েটার ঢং তাদের সংখ্যাগত, গুণগত বা কলেবরগত কারণে যদিও প্রচলিত থিয়েটার ঢংকে মার খাওয়াতে পারেনি, তবু যে কিছু দল কিছুটা হলেও সফলতা পেয়েছে, তাদের মধ্যে ‘বাঙলা থিয়েটার’ অন্যতম। এটি ১৯৯১ সালে সংগঠিত হয় কিছু পেশাদার শিল্পী, পরিচালক ও সজ্জাকরদের নিয়ে। তাঁরা আজ পর্যন্ত পাঁচটি নাটক করে দেশে ও বিদেশের মাটিতে সফলতা পেয়ে রুগ্ণপ্রায় রেপার্টরি ঢংয়ের গোড়ায় পানি দিতে সক্ষমতা দেখিয়েছেন। নাটকগুলো হলো ‘মানুষ’, ‘আদিম’, ‘লেবদেফ’, ‘চের সাইকেল’ এবং বর্তমান প্রযোজনার নাম ‘দ্য ডিসট্যান্ট নিয়ার’। ‘দ্য ডিসট্যান্ট নিয়ার’ বাংলার নাট্য ইতিহাসের গনগনে নক্ষত্র, নির্ভীক যোদ্ধা, সফল সংগঠক এবং টেলিভিশন ও মঞ্চের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী মামুনুর রশীদের একক অভিনীত নাটক। নাটকে তিনি দুই দিগ্বিজয়ী সাহিত্যিক উইলিয়াম শেকসপিয়ার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সৃষ্টি নিয়ে নাট্য-সংলাপ আওড়েছেন।
মূলত নাটকে শেকসপিয়ারের সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতা ও অনুসরণ-প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া দুই কবির সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির একটা চেষ্টা রয়েছে। তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টি যে শত শত বছর পরেও আবেদনে পরিপূর্ণ, সময়সাপেক্ষতার বিচারে সফল, তাও দেখানো হয়েছে। দ্য ডিসট্যান্ট নিয়ারে একক শিল্পী মামুনুর রশীদ একাধারে কিং লিয়র, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, অ্যান্টনি, ক্লিওপেট্রা, অমল, অমিত, জুলিয়াস সিজার, অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা_একেকটি চরিত্র একেক রূপের, ঢঙের, বৈশিষ্ট্যের, বয়সের, রুচির, মননের, ঐশ্বর্যের, দেশের, সমাজের। তবু মামুনুর রশীদ একাই যেন সব গুণের অধিকারী। হাল্কা কিছু কস্টিউম চেঞ্জ করে যে হয়ে উঠেছেন একেক রূপে উদ্ভাসিত আর ওই চরিত্রকে মঞ্চে করে তুলেছেন জীবন্ত, প্রাণবন্ত। এটা বোধ হয় শুধু মামুনুর রশীদের ক্ষেত্রেই সম্ভব। সামান্য মঞ্চসজ্জার মধ্যে সব আবেদন, সব আকাঙ্ক্ষা যেন তাঁর অভিনয়ে। তাঁর ইংরেজিতে প্রাজ্ঞতাও এই নাটকের মধ্যে ফুটে উঠেছে। মঞ্চে তিনি প্রতিটি ক্ষণে চমৎকার সাবলীলতার সঙ্গে ইংরেজি সংলাপ উগরে দিয়েছেন। শুধু সেখানেই তিনি শান্ত নন, মঞ্চে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ও কণ্ঠস্বরে সংলাপ আওড়ালেও ব্যাকগ্রাউন্ড ভোকালে তাঁর ভরাট আবার দৃঢ়কণ্ঠের সংলাপ যে কাউকেই উদ্বেলিত করবে_এটাই যেন স্বাভাবিক চিত্রায়ণ। তিনি একবার প্রশ্নকর্তা, একবার উত্তরদাতা। ভারি নির্লিপ্ত একটা সমন্বয় তাঁর পুরো অভিনয়ে, পুরো অভিব্যক্তিতে। এটাই হয়তো মামুনুর রশীদের অর্জন। তাঁকে সাধুবাদ, ধন্যবাদ বা অভিবাদন না জানানোর কোনো কারণ বোধ হয় নেই।
ছোট্ট পরিসরে গভীর থেকে অতি গভীরতর প্রজ্ঞায় নিয়ে গেছেন গল্প ও নাট্য আবহকে। নাটকটির পরিচালক ফায়েজ জহির। তিনিও সফল তাঁর কর্মযজ্ঞে। গল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষুদ্রতর ব্যবহার ভালো হয়েছে। এতে একঘেয়েমিতা বা নাটকের পরিসর বাড়েনি বলে এ প্রয়াসও সফল। এ জন্য সংগীত পরিচালক অমিত মলি্লকের মেধার মূল্যায়ন হিসেবে মেধাবী বলা বেশি হবে না। ছোট্ট ও সামান্য মঞ্চ অনুষঙ্গ মঞ্চের সৌন্দর্যবর্ধনে সহায়ক হয়েছে। দৃষ্টিনন্দনতা দানের জন্য আজাদকে সাবলীল মনে করা যায়। বিষয়বস্তু নির্বাচন বা ভালো নাটক উপহার দেওয়ার জন্য সব দর্শকের পক্ষ থেকে শহিদুল মামুনকে অবশ্যই হাততালি বা প্রশংসাবাণী শোনানো উচিত মনে করছি। কারণ এখানে তাঁর গবেষণাধর্মী মননের সফলতা পাওয়া যায়। সব শেষে বাংলা থিয়েটারের কাছে আরো ব্যতিক্রমী নাটক চাইতেও ভুলছি না।