সংবাদ

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আজ


মাহতাব শফি

প্রিয়জনের নাম মনের নীরবতায় অথবা বইয়ের পাতায় আশ্রয় না দিলেও প্রেমের জন্য আলাদা একটা দিন জায়গা পেয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতায়। অনেকটা লড়াই করে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে দিনটি। আজ সেই ভ্যালেন্টাইনস ডে Ñ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ‘ভালবাসি’ শব্দটি সারাবছরে আমরা বহুবারই বলি। ঠিক যেমন আকাশ বলে; আর মাটি শোনে রোদে, মেঘে, অন্ধকারে নিত্যকাল। তবু ‘ভালবাসি’ Ñ এই কথাটা আজ যেন নতুন করে বলা হয়। প্রেম, যার জ্যোৎস্নায় নদী হরিণ হয়ে যায়। সেই প্রেম, যা হৃদয়কে ভাসিয়ে দেয় স্বর্গের জলে। আজকের রোদটাও যেন আলাদা। ভালবাসার মতোই এক হিরণ¥য় আধার।
ফাগুনের দ্বিতীয় প্রহরে আজ উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রতিবারের ন্যায় এবারও দিবসটিকে ঘিরে মনে মনে লেগেছে আনন্দের ঢেউ। দোকানে দশটা তাকের মধ্য থেকে একটা পছন্দের উপহার নামিয়ে নেওয়া। ফুলের গোছা থেকে সবচেয়ে স্মার্ট অর্কিড অথবা গোলাপকে বেছে নেওয়া। হৃদয়ে খোদাই করা নাম কার্ডে লিখে প্রিয়জনকে জানানো Ñ ‘পাশে আছি, থাকবো’। গত কয়েক দিনের এত প্রস্তুতি, সবই তো আজকের জন্য।
ভ্যালেন্টাইনস ডে-র পাশ্চাত্য প্রভাব নিয়ে যাঁরা নাক সিঁটকান আজকের দিনে কিন্তু তারাও বেশ উদার। আজকের দিনে কত লোকের হৃদয় জোড়ে। ভাঙেও কারোও কারোও। কত প্রেম হতে হতে হয় না, কত আবার হঠাৎ করেই প্রেমের ঠিকানা খুঁজে নেয়। শুধু চোখের ইশারা থেকে অদৃশ্য অনুমতি আজকের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে।
ভালোবাসা দিবসের সময়টা এখন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কেননা এই দিবসটা এমন সময়ে পালিত হয় যখন বাংলাদেশে বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটে৷ বসন্ত ঋতুর ক্ষণগণনা শুরু হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে, যার একদিন পর আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে৷ একদিন আগে পরে এই দুইটি দিন উদযাপিত হওয়ায় যুবক-যুবতীদের উৎসবসংস্কৃতিতে মহাউৎসবের রূপ পেয়েছে। আর রাজধানী ঢাকার যুবক-যুবতীদের কাছে এ দিনটি আরো উৎসবের আমেজ পায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার কারণে৷
ভালোবাসা মানুষের হৃদস্পন্দনে এনে দেয় প্রশান্তির রঙিন ছায়া। দিবসটি তরুণ-তরুণীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এবং উদযাপিতও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সময়ের সন্ধিতে প্রিয় মানুষের সাথে এ প্রিয় ক্ষণকে উপভোগ্য করে থাকে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ফুল, কবিতা, কার্ড ও উপহার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। তবে সময়ের বিবর্তনে এ ধারার ভিন্নতা এখন লক্ষ্যণীয় পরিববর্তিত হচ্ছে। মুঠোফোন, এসএমএস ও ইন্টারনেটের ফলে ভালোবাসা মুহূর্তেই কাছাকাছি নিয়ে আসে প্রিয় মানুষটিকে। প্রযুক্তির কল্যাণে ভ্যালেন্টাইন ডে’ও এখন পেয়েছে নতুন মাত্রা। ভালোবাসা সামাজিক প্রেক্ষাপটকে করে তোলে সুন্দর। মানুষের আত্মজকে করে তোলে সমৃদ্ধ।
এ দিবসটি যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে দিবসটি বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে আনন্দ উন্মাদনার সঙ্গে পালন করা হয়। প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবদেবীর রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারও কারও মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। আবার কেউ বলেন, রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস ২০০ খ্রিস্টাব্দে দেশে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনো যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ। তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে, তবে যুদ্ধ করবে কারা? সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এক যুবক। যার নাম ভ্যালেন্টাইন। অসীম সাহসী এ যুবকের প্রতিবাদে খেঁপে উঠেছিলেন সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- দেওয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলা হয় তার। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এ দিনটিকে পালন করা হয় ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে। তবে এটিও সর্বজনস্বীকৃত নয়। এখানেও দ্বিমত আছে। কার কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো। একদিন রোমের এক কারাপ্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। তার আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর কারা প্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন মেয়েটিকে। তাতে লেখা ছিল, ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রঙ দেখতে পেয়েছিল কারণ এরই মধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দুচোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ভালোবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন।
তবে কোন প্রথা বা কুসংস্কার নয়, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের ফুলেল সৌরভ ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের প্রত্যেকেরই আঙিনায়। ভালোবাসা জড়ানো তারুণ্যের রঙিন সুতোয় বোনা সুখস্বপ্নগুলো যেন চিরস্থায়ী হয়ে ফুটে থাকে সবসময়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ভালোবাসার নির্লোভ সম্মোহন আমাদের করে তুলুক আরও সুন্দর। ভালোবাসা শুধু বিশেষ দিন-দিবসে নয়, প্রতিটি মুহূর্তে আমদের ভেতর জড়িয়ে থাকুক।