Uncategorized

মানুষ দুঃখ পেতেও যে ভালোবাসে তার জলজ্যান্ত স্বাক্ষর ‘কবর’


লিখেছেন-মাসিদ রণ

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের পল্লীকেন্দ্রিক কবিতাসম্ভারের মধ্যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ‘কবর’ কবিতাটি। কাব্যপ্রেমী এমন কোনো পাঠকই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি ‘কবর’ পড়েননি বা ‘কবর’-এর প্রেমে পড়েননি। ‘করব’ কাব্য যখন শ্রুতির পর্যায়ে থাকে বা পঠনরত হয়, তখন এর গল্পের ভাঁজে নিজের কল্পনার রং ছড়িয়ে দেওয়া লোকের সংখ্যাও কম নয়। মূলত কাহিনীকাব্য সব সময় পাঠকের এই গ্রহণযোগ্যতাটুকু পেয়ে থাকে। তবে ‘করব’ তো আনকোরা বা বৈজ্ঞানিক কিংবা অতিকল্পিত কিছু নয়। এর রূপরেখা মানুষ শিল্পীর নিবিড় নিমগ্নতার সঙ্গে আঁকা চিত্রকল্পের মতো মনুষ্যপটে এঁকে যায় অহরহ।

অবরেণ্যকে বলার মতো অভিলাষ তো হামেশাই আমাদের মনে অবস্থান করে। সোজা করে বলতে গেলে মানুষ দুঃখ পেতেও যে ভালোবাসে, তার একটি জলজ্যান্ত স্বাক্ষর পল্লীকবির ‘কবর’। আমরা কখনো কখনো সাধারণ জীবনের বাইরে যেতে চাই। একটু অন্যরকম করেই নিজেকে ফিরে পেতে চাই। তার খোরাকও জোগায় এই ‘কবর’। যে যার পছন্দমতো বৃদ্ধ সেই দাদা অথবা নাবালক নাতি, পরির মতো মেয়ে নাতনি, অভিমানী বউ, পতিব্রতা পুত্রবধূ বা পুতুল খেলার বয়সী সেই সাপে কাটা মেয়ে হতে চাই। বিশেষত দাদা হয়ে নিজের আপনজনকে হারানোর মিথ্যার আদলে সত্য যন্ত্রণা ভোগ করি আমরা। এই সুযোগটা আরো একটু জোরদার করেছেন নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক দীপা খন্দকার। তিনি এই রাজনৈতিক বৈরী পরিস্থিতিতেও আমাদের দেড় ঘণ্টা সময় ভীষণ রকম নস্টালজিক করে তুলেছিলেন, যাঁরা উপস্থিত ছিলাম ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূল মিলনায়তনে। আসলে এ দিনই দীপা খন্দকারের নির্দেশিত ‘কবর’ নৃত্যনাট্যের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। এই ‘কবর’-এর পাটাতন পল্লীকবির সেই ‘কবর’ই।

দীপা খন্দকার জসীমউদ্দীনের কাহিনীকে নিজের মতো করে ইম্প্রোভাইজ করেছেন, আর সুজেয় শ্যাম তাঁর হৃদয়ছোঁয়া মিউজিক দিয়ে, নৃত্যশিল্পীরা পায়ের ঘুঙুর আর দেহের তালে তালে খেলেছেন গল্পের গভীরতার সঙ্গে। এ জন্য দীপা খন্দকার কৃতিত্বটা পাওয়ার যোগ্য বলেই মনে হচ্ছে। ‘করব’-এর পর্যায়ক্রমিক প্রিয়জন হারানোর বেদনা বিধুর আখ্যানে তিনি অনেক মজার উপাদানও নিয়ে এসেছেন। তাই দর্শক আলাদাভাবে বিনোদিত হয়েছে। দেড় ঘণ্টা সময় শুধু আমরা কবরের অসীম অন্ধকারেই ঢুকে থাকি না, ভাসি টুকরো টুকরো সুখের ভেলায়, নিজেকে একটু প্রশান্ত করি, জিরিয়ে নেয় আমাদের অনুভূতির দরজাগুলো। তারই রসদ মেলে, দাদা যখন তরুণ তুর্কি তখন গ্রাম্য মেলায় যাওয়া, দরাদরি করে দোকানির কাছ থেকে পুঁতির মালা কেনা, তা নিয়ে তরুণ বয়সী দাদির সঙ্গে রসিকতা-অভিমান ইত্যাদি। ‘দাদার জীবনের রোজকেয়ামত আর কত দূর?’ এই প্রশ্ন যখন ব্যাকগ্রাউন্ডের ভরাট গলায় দর্শকের কাছে করা হয়, তখন সদুত্তর না দিতে পারার তাড়না চোখে পড়ে দর্শকদের মুখাবয়বে। তারা যেন চিৎকার করে বলতে চায়, এর উত্তর কি কবি নিজেও জানতেন…

আসলে ‘কবর’ উপাখ্যান এভাবেই আমাদের একাত্ম করে দেয় সেই বৃদ্ধ দাদার দুর্বিনীত কষ্টের সঙ্গে। এখানেই তো সার্থক আমাদের পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। আর সেই সার্থকতার আরো একজন ভাগিদার নৃত্যপরিচালক দীপা খন্দকার।

নৃত্যনাট্যের বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করেছেন মোহন, প্রফুল্ল দাস, সৌরভ, রৌদ্র, ঝুনঝুন, অহনা, মিশু, র্সন্, অঙ্কিতা, সীমান্ত, এনায়েত, প্রাণ প্রমুখ। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন জনপ্রিয় ফোকসংগীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ও মুজিবুর রহমান, আলোতে ছিলেন সবুজ ভুঁইয়া ও পরিবেশনায় দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রত্যেকে যে যাঁর জায়গায় ভালো করেছেন বলেই পুরো আয়োজনটা আরো উপভোগ্য হয়েছে।