খেলাধুলা

সোনালি দিগন্তে বাংলাদেশ


ইফতেখার শুভ
মাঘের বিকেলের মিষ্টি রোদ ততক্ষণে গায়ে মেখেছে পুরো মিরপুর স্টেডিয়াম। সেই রোদে চিক চিক করছিল উপস্থিত দর্শকদের চোখ-মুখ। পুরো স্টেডিয়ামজুড়েই ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনি। তাদের উচ্ছ্বাসে বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আর ঠিক তখনই বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান জাকির হোসেন লংঅনের ওপর দিয়ে বল সীমান ছাড়া করলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে পরাজিত হলো নেপাল। মিরপুরের আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। পড়বেই না কেন? বাংলাদেশ যে নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে! সাফল্যে যুক্ত হয়েছে নতুন পালক! ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ যে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এই প্রথম সেমিফাইনালে উঠল লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
চলতি ১১তম অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে গতকাল শুক্রবার মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে নেপালকে ৬ উইকেটে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে জুনিয়র টাইগাররা। এর আগে ১০টি যুব বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে মাত্র একবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। তবে ২০০৬ সালের সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ। তাই সেমিফাইনাল খেলা স্বপ্নই ছিল এতদিন। তবে স্বপ্ন এবার বাস্তব। সব অসম্ভব, অঘটনকে মাটি চাপা দিয়ে গতকাল রোমাঞ্চকর ম্যাচে হিমালয়ের দেশকে হারিয়েছে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২১১ রান করে নেপাল। ব্যাটিংয়ে নেপালকে ভালোই ভুগিয়েছে রানআউট। চার ব্যাটসম্যানই হয়েছেন রানআউট! বাংলাদেশি স্পিনাররা ভালো করতে না পারলেও দারুণ ফিল্ডিং এর কারণে বড় স্কোর করতে পারেনি নেপাল। সকালের আদ্র উইকেটে নতুন বলে রানা ও মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বোলিং করেন দারুণ। তবে নেপাল ছিল সতর্ক। তারা উইকেট হারায়নি প্রথম ৫ ওভারে। বাংলাদেশকে প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দেন টুর্নামেন্টে দলের সেরা বোলার সাইফুদ্দিন। কাট করে ভেতর ঢোকা বলে আউট হন ৭ রান করা সন্দিপ সুনার। পরের ওভারেই রানার দারুণ এক বাউন্সারে যোগেন্দ্র সিং কার্কি আউট হন মাত্র ১ রান করে। তৃতীয় উইকেটে ৪৪ রানের জুটিতে নেপাল খানিকটা প্রতিরোধ গড়ে। রানআউটে ভাঙে এ জুটি। তবে এরপর বড় জুটি গড়ে নেপালিরা। অধিনায়ক রাজু রিজাল আর আরিফ শেখ অনায়েসে শাসন করেছেন বাংলাদেশি স্পিনারদের। তবে এই জুটি ভাঙেন অধিনায়ক মিরাজ। রিজালকে ফেরানোর পথই পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। ভুল বোঝাবুঝিতে মাঝ উইকেটে থমকে গিয়ে আউট হন রিজাল। তিনি করেন ৮০ বলে ৭২ রান। এরপর দিপেন্দ্র সিং এইরি ২২ ও প্রেম তামাং অপরাজিত ২২ রান করে নেপালকে নিয়ে যান দুইশ’ রানের ওপারে। ২ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টে নিজের শিকার ৯ উইকেটে নিয়ে যান সাইফুদ্দিন। একটি করে উইকেট নেন অধিনায়ক মিরাজ, সালেহ আহমেদ শাওন গাজী ও প্রথমবার খেলতে নামা রানা।
এরপর ব্যাট করতে নেমে ৯৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ভীষণ চাপে পড়ে বাংলাদেশ। ৬ষ্ঠ ওভারে ১৭ রানের উদ্বোধনী জুটির পর আউট হন ওপেনার সাইফ হাসান। ২১ বলে ৫ রান করেন তিনি। পিনাক ঘোষ ও জয়রাজ শেখেরও নিজেদের সহজাত ব্যাটিংয়ের চেয়ে মন বেশি ছিল উইকেট আঁকড়ে রাখায়। তাতে রানের চাকা খুব দ্রুত না ঘুরলেও গড়ে ওঠে জুটি। ৭৭ বলে ৪৬ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি ভাঙে দুই ব্যাটসম্যানের ভুল বোঝাবুঝিতে।
তবে চাপকে জয় করে দুর্দান্ত এক জুটি গড়েন জাকির ও মিরাজ। সিঙ্গেলস-ডাবল নিয়ে আস্তে আস্তে কাছে এনেছেন লক্ষ্য, দূরে ঠেলেছেন চাপ। জুটি জমে ওঠার পর দারুণ কিছু বাউন্ডারিতে মিটিয়েছেন রান-বলের টানাপোড়েন। দুজনেই পান অর্ধশতক। ৭৭ বলে ৭৫ রান করে অপরাজিত থাকেন জাকির। আর মিরাজ অপরাজিত ছিলেন ৫৫ রানে। এ দুজনের ম্যাচ জেতানো অবিচ্ছিন্ন জুটি ছিল ১১৭ রানের।
গতকালের কোয়ার্টার ফাইনালে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশের যুবারা। এবার সেমিফাইনালে পাকিস্তান কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মোকাবিলা করতে হবে মিরাজদের। সেমিতে জিতলেই ফাইনাল। আর ফাইনালে যে কোনো কিছুই ঘটানোর ক্ষমতা আছে জুনিয়র টাইগারদের। তবে এবারই কি মহাকাব্য রচনা করবে বাংলাদেশ? এ প্রশ্নের উত্তরই হয়তো খুঁজছে অগণিত ক্রিকেটভক্ত।