ইসলাম

হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম শবে কদর বা লাইলাতুল কদর


সূরা কদর
মক্বায় অবতীর্ন : আয়াত-৫
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু-
(১) আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে।
(২) শবে-কদর সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?
(৩)শবে -কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ট।
(৪) এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগন ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
(৫) এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

শবে কদরে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। মূলত এজন্যই রমজান মাস কিংবা রাতের এত গুরুত্ব তাৎপর্য। পবিত্র কুরআন যদি রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে নাজিল হতো, তাহলে মাসেরই গুরুত্ব ফজিলত থাকতো। শবে কদরের এক রাতের ইবাদতকে পবিত্র কুরআনে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে রমজানের শেষ শুক্রবার জুমাতুল বিদাপালিত হয়

 

শবে-কদর
পবিত্র কুরআনে ‘কদর’ নামে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাজিল করে আল্লাহতায়ালা শবে-কদরের গুরুত্ব অল্প কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন ‘আমি একে নাজিল করেছি শবে-কদর। শবে-কদর সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? শবে-কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এটা নিরাপত্তা- যা ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’। সূরা কদর। ২৬ রমজান দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল কদর! কদরের শাব্দিক অর্থ মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। অফুরন্ত মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের পরপ্রেক্ষিতে এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। বিখ্যাত ইসলামিক মনীষী আবু বকর ওরবাক (রা.) বলেন, এ রাতের ইবাদত-বন্দেগীর কল্যাণে একজন নগণ্য মানুষও আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে’।
কদরের আরেক অর্থ হলো তকদির ও হুকুম। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লেখা থাকে, এক রমজান হতে অপর রমজান পর্যন্ত তার সরবরাহের হুকুম ও দায়দায়িত্ব আল্লাহপাক এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাজি.)-এর বর্ণনামতে শবে-বরাতে আল্লাহ এক বছরের জন্য বান্দার রুজি-রিজিক, হায়াত-মউত ও অন্যান্য তকদীরী ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আর শবে কদরে সে সকল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ ও রুজি-রিজিক প্রভৃতি সরবাহের দায়িত্ব আল্লাহ ফেরেশতাদের দিয়ে দেন (কুরতুবী)।
মুহাদ্দিস ইবনে আবি হাতেম (রহঃ) তাফসীরের ইমাম মুজাহিদ (রহঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলল্লাহ (সাঃ) একদিন সাহাবায়ে কিরামদের বৈঠকে বনি ইসরাইলের এক মুজাদিদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি এক হাজার মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরামের আফসোস হয় যে, এক হাজার মাস অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাস তো-এ যুগের অনেকে জীবনও পায় না। তাই হযরত মূসা (আঃ)-এর উম্মত বনি ইসরাইলের মতো এতো অধিক সাওয়াব লাভের অবকাশও উম্মতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর নেই। সাহাবায়ে কিরামের এ আফসোস-অনুশোচনাকালে হযরত জিবরাইল (আঃ) আল্লাহর পক্ষ হতে কুরআন মজিদের সূরা কদর নিয়ে হুজুর (সাঃ)-এর কাছে আগমন করেন।
তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে ইবনে জরীর (রহঃ) কর্তৃক অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ রয়েছে- বনি ইসরাইলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত ইবাদতে মশগুল থাকতো ও সকাল হতেই জেহাদের জন্য বের হয়ে যেতো এবং সারাদিন জেহাদে লিপ্ত থাকতো। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর প্রেক্ষিতেই আল্লাহতায়ালা সূরা কদর নাজিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শবে-কদর শুধু উম্মতে মুহাম্মদীরই বৈশিষ্ট্য। -(মাযহারী)
হাদিসে রয়েছে পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রজনীতে শবে-কদর নিহিত। কথা হলো, তাহলে আমরা রমজানের ২৬তম দিবাগত রাত কেন শবে-কদর উদ্যাপনে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি? এ প্রশ্নের জবাবের আগে শবে-কদর এমন উহ্য রাখার হেতু সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। শবে-কদরকে গোপন রাখার মধ্যে রয়েছে আল্লাহতায়ালার বিরাট হিকমত ও রহস্য। প্রত্যেক মূল্যবান বস্তু হাসিল করা যেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তেমনি আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো এ মহামূল্যবান রাতের অনুসন্ধানে বান্দাগণ সাধনা করুক, এক রাতের জন্য ৩০টি রাত জাগ্রত থাকুক। মানুষ দুনিয়ার কতো তুচ্ছ জিনেসের জন্য কতো রাতের নিন্দ্রা হারাম করে দেয়। কিন্তু হাজার মাসেরও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন একটি রাতের জন্য কিছু কষ্ট স্বীকার করতে পারে না। ওলামায়ে কিরামগণ শবে-কদরের গোপনীয়তার আরেকটি রহস্য এভাবে ব্যক্ত করেন যে, শবে-কদর যদি নির্দিষ্ট রাতে অনুষ্ঠিত হতো এবং তা’ মানুষের জানা থাকতো, তবে অনেক অলস ও গাফেল হতভাগ্য ব্যক্তি এমন একটি মহান রাতের মর্যাদা না দিয়ে আল্লাহর গজবে পতিত হতো। এ জন্য উচিত হলো শেষ দশকের প্রতি বেজোড় রাতে জাগ্রত থেকে কিছু জিকির-আজকার, তসবীহ-তাহলীল, তেলাওয়াত, নফল নামাজ প্রভৃতির মাধ্যমে শবে-কদরের ফজিলত অর্জনের চেষ্টা করা। অন্তত এশা ও ফজর নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা। হাদিসে রয়েছে এশা এবং ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা প্রকারান্তরে সম্পূর্ণ রাত ইবাদত করার সমতুল্য।
এবার ফিরে আসি রমজানের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে কেন আমরা শবে-কদর উদ্যাপন করি সেদিকে। কাজী খান, মাআরিফুচ্ছানান কিতাবে শবে-কদরের ইবাদতের জন্য ২৭ তারিখের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাফসীরে ইবনে কাসীরে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- ‘শবে-কদর নির্দিষ্ট দিনেই হয়ে থাকে’। ২৭তম রমজানে শবে-কদর পালনের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে হযরত আবু হানিফা (রহঃ)-এক মতে বলেছেন, কদরের ফজিলত বর্ণনা করে পবিত্র কুরআনে যে সূরায়ে কদর নাজিল হয়েছে, তাতে ‘লাইলাতুল কদর’ বাক্যটিতে ৯টি অক্ষর রয়েছে। সে হিসেবে ৩*৯=২৭ রমজানকেই আমরা শবে-কদর হিসেবে পালন করি।
শবে-কদরের ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে খুব অল্প কথায় ব্যাপক কথা বলা হয়েছে- শবে-কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এখানে কতো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তারপরও যদি একে কমপক্ষে এক হাজার মাস ধরা হয়, তাহলে হিসেব করলে দেখা যায় তা’ ৮৩ বছর ৪ মাস হয়ে থাকে। অর্থাৎ শুধু শবে-কদরের একটি রাতে ইবাদতের দ্বারা ৮৩ বছর ৪ মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে ইবাদত করার সাওয়াব পাওয়া যাবে বলে হাদিস বিশারদগণ বলেছেন। বর্তমান পৃথিবীর মানুষ গড়ে মাত্র ৪৮ বছর হায়াত পায় বলে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে। এককভাবে দেখা গেলে প্রতীয়মান হয় যে, আশি বছরের অধিক হায়াত অনেকের ভাগ্যেই এখন আর জোটে না। সে মতে হিসেব করলে দেখা যাবে, ৮০ বছর কেউ হায়াত পেলে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা হিসেবে তার হায়াতের ৪০ বছর রাত থাকে, জাগ্রত মাত্র ৪০ বছর। এ ৪০ বছর হিসেব করলে দেখা যাবে যারা নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তারা প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করেন। সে হিসেবে দৈনিক মাত্র সোয়া এক ঘন্টা সময় মানুষ ইবাদতে কাটায়।
এ হিসেব মতে, সার্বসাকুল্যে দেখা যাবে ৮০ বছরের জীবদ্দশায় মাত্র ১ থেকে দেড় বছর ইবাদতে কাটানো হয়। অথচ শুধু শবে-কদরে এক রাতে ইবাদতের মাধ্যমে একাধারে ৮৩ বছর ৪ মাস ইবাদতের ফজিলত পাওয়া যায়।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে- যে ব্যক্তি শবে-কদরে দন্ডায়মান থাকে অর্থাৎ ইবাদত করে দ্বীনের হুকুম মনে করে এবং সাওযাবের নিয়তে, তবে তার অতীত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তাই শবে-কদরের ইবাদত মানবজীবনের পাপমুক্তি ও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য অপরিসীম কল্যাণকর। শবে-কদরের ইবাদতের মধ্যে রয়েছে নফল নামাজ আদায়করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, জিকির-আজকার করা, তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করা, দরুদ শরীফ বেশি পরিমাণে পড়া, দান-সদকা করা ইত্যাদি। তাইতো প্রতিটি মুসলমানের উচিত এ রাতে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে নিজ পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নেয়া। কারণ, নবী করিম সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের মতো পুণ্যময় মাস পেয়েও তার পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়, তার ধ্বংস অনিবার্য।

-অনলাইন অবলম্বনে