Uncategorized

আরব্য রজনীর আয়েশ দেয় ‘বাঁদী-বান্দার রূপকথা’


মাসিদ রণ (আল-মাসিদ)

শৈশবে দাদি বা নানির কোলে শুয়ে শীতের রাতে গল্প শোনেনি এমন বাঙালি খুব কমই আছে। শৈশবের এসব গল্পের অধিকাংশ জায়গাজুড়েই থাকত সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামান, সাত ভাই চম্পা, কটকটি বুড়ি কিংবা আরব্য রজনীর ঘটনা। আসলে এসব গল্পগাথাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঙালির ভেতরে প্রোথিত হয়ে আছে। ব্যস্ত জীবন অথবা মুষড়ে পড়া সময় যখন আমাদের ক্রমাগত গ্রাস করতে থাকে, নিজের প্রয়োজনে তখন অজান্তেই আমরা ভীষণ রকম নস্টালজিক হয়ে পড়ি। মনের আঙিনায় হরহামেশাই ঘোরে-ফেরে প্রিয়মুখ, প্রিয় অনুভূতি, সাফল্যগাথা। বাদ যায় না দাদি বা নানির কোলে শুয়ে শুয়ে শোনা গল্পগুলোও।

গল্পগুলোর চরিত্র, ঘটনা নিয়ে তখন কী যে উত্তেজনা ছিল, তা যাঁরা এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন। ওই ঝঞ্ঝাটহীন সময়টায় কত লগ্ন যে পার হয়েছে, দুধ পরির সেই সফেদ ঘেরওয়ালা জামার কথা ভেবে, দৈত্যের সেই ইয়া বড় বড় দাঁতের কথা ভেবে, এমনকি মর্জিনার সেই প্রখর বুদ্ধিমত্তা নিজের ভেতর আওড়াতে আওড়াতে। ইস, রূপকথার সেই চরিত্রগুলো যদি বাস্তবে কখনো ধরা দিত! এমন ভাবনা কি কম করেছি আমরা? কিন্তু তখন কি আর সেই সৌভাগ্য হয়েছে?

‘সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার’। তাঁরা মঞ্চে এনেছে হাজার বছরের রহস্যে আবৃত আরব্য রজনীর অতি জনপ্রিয় এই গল্প ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাঁদী-বান্দার রূপকথা’।

বদলোক কাসেম ক্রীতদাস আব্দুল্লা ও পরমা সুন্দরী ক্রীতদাসী মর্জিনাকে হাট থেকে কিনে এনে চরম নির্যাতন করে। শুধু ক্রীতদাস-দাসী নয়, আপন ভাই আলী বাবাকেও তার কূট মন্ত্রে নিঃস্ব করে দেয়। একদিন সৎ লোক আলী বাবা এক গুহার কাছে যায় এবং সেখানে অনেক রকম অমূল্য রত্ন পেয়ে আবারও বড়লোক হয়ে যায়। এই লোভে কাসেমও ওই গুহা থেকে ধনরত্ন আনতে যায়। কিন্তু অসৎ লোক বলে তার মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। এই গল্প সবারই জানা। এই চিরচেনা গল্পই ধরা দিয়েছে নৃত্যের তালে তালে, সুরের ছন্দে ছন্দে।

‘বাঁদী-বান্দার রূপকথা’ গত ৫ ও ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয়। এ নৃত্যনাট্যের নৃত্য ভাবনা ও নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন কানাডাপ্রবাসী কলকাতার প্রখ্যাত কোরিওগ্রাফার সুকল্যাণ ভট্টাচার্য।

আব্দুল্লা চরিত্রে রূপদান করেছেন আনিসুল ইসলাম হিরু, আলী বাবা চরিত্রে শিবলী মহম্মদ, মর্জিনা চরিত্রে শামীম আরা নীপা, ফাতেমা চরিত্রে ডলি ইকবাল ও খলচরিত্র কাসেমের ভূমিকায় এ নৃত্যনাট্যের পরিচালক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। আর এর সংগীতায়োজন করেছেন কলকাতার জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক জয় সরকার। গানগুলো নেওয়া হয়েছে ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের একটি রচনা থেকে, সলিল চৌধুরীর একটি সিনেমা থেকে আর জয় সরকার ও নচিকেতার কাছ থেকে। গেয়েছেন লোপামুদ্রা মিত্র, নচিকেতা, শ্রীকান্ত আচার্য্য, অন্বেষা, রাঘব, জয়তী ও মনোময়। গানের পাশাপাশি চরিত্রানুযায়ী বাচিক অভিনয়ও করেছেন তাঁরা। আর মর্জিনা চরিত্রের নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইন্দ্রানী হালদার।

নতুন অনেক কিছুই আছে এ নৃত্যনাট্যে। যেমন, এর মধ্যে এমনও শিল্পী আছেন, যাঁরা আগে কখনো বাচিক অভিনয়ের কাজটি করেননি। এ ছাড়া গল্পের প্রয়োজনে মরুভূমি কিংবা গুহার মতো দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য এই নৃত্যনাট্যে মাল্টিমিডিয়া ইনপুট, থ্রিডি প্রজেকশন ম্যাপিং ব্যবহৃত হয়েছে। দর্শকদের কাছে আরো জীবন্ত করার জন্যই প্রয়োজন অনুযায়ী প্রজেকশনের মাধ্যমে দৃশ্যগুলো সাজানো হয়েছে। নৃত্য পরিচালক সাধারণত ইন্ডিয়ান কন্টেম্পরারি ডান্স করে থাকেন। এ নৃত্যনাট্যেও কন্টেম্পরারি নাচের ছোঁয়া রয়েছে।

নৃত্যনাট্যের শুরু হয় এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আব্দুল্লার উপস্থিতিতে। মূলত তাঁর জবানিতে পুরো গল্পটি দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে দর্শক দেখতে পেয়েছে আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের পরিচিত কাহিনী। এখানেও নতুনত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায়। কেননা দেশে এর আগে আর কোনো নৃত্যনাট্যে ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে ‘বাঁদী-বান্দার রূপকথা’ মসলানির্ভর আখ্যান, রোমান্টিক আমেজ বা কমেডির মিশেল মনে হলেও আব্দুল্লার প্রেমে পরাজিত হওয়ার ঘটনা কিন্তু অন্য কথা বলে। ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’ প্রাচীনকালের স্বাক্ষর বহন করলেও এর আবেদন একটা জায়গায় অন্তত বড়ই সমসাময়িক। আর তা হলো ‘অর্থের মানদণ্ডে মানুষ মাপা’র প্রবৃত্তি। মন থেকে ভালোবেসেও মর্জিনাকে পায়নি আব্দুল্লা। কারণ সে গরিব, সর্বহারা ক্রীতদাস মাত্র। তার মতো মানুষের কি প্রেম-ভালোবাসা করা শোভা পায়! তাইতো চোখের সামনে আলী বাবা পুত্র হুসেনের সঙ্গে প্রাণপ্রিয় প্রেয়সী মর্জিনার মিলন দেখতেও তার ভাগ্য তাকে প্ররোচিত করে। তখনো আব্দুল্লা বলতে পারে না, ‘আমি মর্জিনাকে বড্ড ভালোবাসি।’

যাহোক, এই নৃত্যনাট্যের সমসাময়িকতার বিচারে আমরা আরো একটি বিষয় দেখতে পাই। তা হলো, ‘সৎ শক্তির জয় আর অসৎ শক্তির পরাজয়।’ এই মর্মবাণীর ফলপ্রসূতা আমাদের এই ভঙ্গুর সমাজে বড় দরকার। আরো অনেক কিছুর মতো দরকার এমন সব বড় আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া।

– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/silalipi/2015/01/09/173028#sthash.tLtSCcTZ.dpuf