Uncategorized

‘স্ত্রীর পত্র’-এর মৃণাল এখন ঘরে ঘরে


আল মাসিদ রণ

রবীন্দ্রনাট্য চর্চায় ঢাকাই মঞ্চে যে কয়টি গ্রুপ থিয়েটার খুবই সক্রিয় তার মধ্যে জিয়নকাঠি দলটি অগ্রগণ্য। এই দলে রবীন্দ্রনাথের চারটি ভিন্ন আঙ্গিকের রচনাকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে চারটি নাট্য উপাখ্যান। এ সংখ্যা বিচার বা ব্যতিক্রম ভাবনা নিয়ে একটু ভাবলেই স্পষ্ট হয় জিয়নকাঠি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সব সময় ভাবছে। শুধু ভাবনাতেই তারা সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সেই ভাবনাকে প্রাণ নিয়ে মঞ্চে করে তুলেছে ছন্দময়, শৈল্পিক এক রক্ত মাংসের জীব। জীব এই কারণে বলা, কারণ রবীন্দ্রনাথের ছায়াকে আবর্তিত করে যে চারটি নাটক_শিশুতীর্থ, তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, রাশিয়ার চিঠি ও স্ত্রীর পত্র মূর্ত হয়েছে সব কয়টিই যেন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবসত্তার মতো বলে গেছে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদির বিপরীত সুর। তবে চারটি নাটকের স্ত্রীর পত্র মঞ্চ ফসলটি একটু আলাদা তার বিষয়সূচি, শিল্পমান, বর্ণনা, বাণী এবং পরিবেশনায়। স্ত্রীর পত্র একের পক্ষে একক অভিনীত নাটক তার ওপরে এর ভাবনার জায়গাটি নিঃসন্দেহে স্বকীতার প্রশ্নে ভালোভাবেই উতরে যাবে। কারণ হিসেবে দর্শক, সমালোচক, নাট্যবোদ্ধা বা সংশ্লিষ্ট যে কারও চোখে একটি বিষয় খুব সহজে ধরা পড়বে। সেটা হলো রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প ‘স্ত্রীর পত্রে’ তার সময়কার গৃহকর্ত্রীদের অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা বলেছেন। আর স্ত্রীর পত্র নাটকের মঞ্চ বর্ণনায় সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র গৃহকর্ত্রীদের মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক অবস্থানের স্বরূপ উঠে এসেছে।

প্রায় ১০০ বছর আগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, ঘরের কোণে বন্দি নারী মৃণালের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথ তার স্ত্রীর পত্র ছোট গল্পে দেখিয়েছেন। এত দিন পর সেই স্ত্রীর পত্র নাটক কতটা সময়োপযোগী তার উত্তর পাওয়া যায় নাটকে মৃণাল চরিত্রে রূপদানকারী একক অভিনেত্রী ফেরদৌসী আবেদিন লিনার রূপসজ্জা, তাঁর আঙ্গিকগত অভিনয় ধারা ও মানসিক অবস্থান থেকে। মৃণাল আর লিনা দুই শতকের দুই চরিত্র, সামাজিক অবস্থানও ভিন্ন। মৃণালকে ঘরের বাইরে যেতে যুদ্ধ করতে হয়েছে, ছবি আঁকা-কবিতা লেখার মতো শিল্পচর্চাও করতে হয়েছে একেবারে নীরবে-নিভৃতে ঘরের অন্ধকার কোণে। আর এ যুগের লিনারা কী করবে সে সিদ্ধান্ত তারা ঘরের বাইরে বসেই নিচ্ছে। শিল্পচর্চায় তারা মঞ্চ, টেলিভিশন, সিনেমা হলের রুপালি পর্দায়ও জায়গা করে নিয়েছে। তবে এই ১০০ বছরে মৃণাল আর লিনার যে সামাজিক অবস্থার ভেদাভেদ তা কি কেবলই বাইরের নয়? একান্ত নিজের মধ্যে, আত্মার খুব কাছাকাছি তারা তো এখন অবধি এক ও অভিন্ন। আর তাই স্ত্রীর পত্র সমসাময়িক বিষয় বিবেচনায় উত্তীর্ণ। বিষয়গত দিক বাদে পরিবেশনাগত দিক দিয়েও স্ত্রীর পত্র তথা একক অভিনয় শিল্পী ফেরদৌসী আবেদীন লিনা অনন্য এবং আধুনিকতার পূর্ণ দাবিদার। আর এই আধুনিক মঞ্চ ফসলের বড় কৃতিত্ব পরিচালক বিপ্লব বালা। তিনিই ‘স্ত্রীর পত্র’ ছোটগল্পকে মঞ্চে করে তুলেছেন সাম্প্রতিক ‘স্ত্রীর পত্র’ নাটক। তৎকালীন মৃণাল আর বর্তমান মেয়েদের সমন্বয় ও একত্বসূচক বাণী আওড়াতে পোশাক পরিকল্পনা যথেষ্ট সহায়তা করেছে। এ জন্য ওয়াহিদা মলি্লক জলি ও তামান্না জেনিফার মুন সফল হয়েছেন। সময় ও ক্লাইমেঙ্রে জায়গাগুলো জোরালো করতে ঠাণ্ডু রায়হানের আলোক প্রক্ষেপণ চমৎকার। মঞ্চ পরিকল্পনা ও প্রপস দিয়ে একক শিল্পী তাঁর অভিনয়ের মধ্যে আলাদা অনুভূতির যোগ দিয়েছেন। মঞ্চ পরিকল্পনায় কামাল উদ্দিন কবির মেধার পরিচয় দিয়েছেন। রূপসজ্জাকর তৃষ্ণা সরকার অত্যন্ত সাবলীল মেকআপ দিয়ে অভিনেত্রীকে দর্শকের কাছে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন।
অনবদ্য সংগীত আয়োজন করেছেন মেহেদী হাসান। এই সংগীতের ব্যবহার গল্পের বাঁক পরিবর্তন করেছে অবলীলায়। তাই দর্শক ভিন্ন আমেজের রস আস্বাদনের সুযোগ পেয়েছে। অভিনেত্রী লিনা ও তাঁর অভিনয় পেয়েছে ছন্দময় অনুভূতি, যা দর্শক বিমুগ্ধ চিত্তে গ্রহণ করেছে। সংগীত ও নেপথ্য কণ্ঠ দান করেছেন তানিয়া মান্নান, শাহীনা পারভীন, লতিফুন জুলিও, শাহিনা দ্বিজু, আশরাফী মিথুন ও ফাহমিদা শান্তা। একাধিক কণ্ঠ শিল্পীর কণ্ঠ ব্যবহার করায় নাটকের একঘেয়েমি ভাব দূর হয়েছে।
এ ছাড়া নাটকে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে’ নাটকের শেষ দৃশ্যের সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার। যখন মৃণাল ঘর থেকে বাইরে আসার যুদ্ধে বিজয়ী তখন মুক্ত আকাশে হৃদয়ের আকুলতা ছড়িয়ে দেওয়ার সুখে মগ্নপ্রায় অভিনেত্রী ফেরদৌসী লিনা। আবার গল্পে বিয়ের দৃশ্যে ‘আমের তলায় ঝামুর ঝুমুর’ শীর্ষক ছড়া গান যেন দর্শককে নিয়ে গেল শৈশবে। এভাবেই গল্পের বাঁকে বাঁকে বেঁধে ফেলতে সক্ষম অভিনেত্রী রূপী লিনা। স্ত্রীর পত্রের মৃণাল আর লিনা যেন একে অপরের প্রতিচ্ছবি।