ক্যাম্পাস

ভ্যাট স্যাটায়ার, আন্দোলনের ভিন্নস্বর

উদিসা ইসলাম

শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাশাপাশি এ আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়ে সূক্ষ্ম বিদ্রুপ (স্যাটায়ার), রসাত্মক বাক্য আর ফান পোস্টে ভরে গেছে সামাজিক মাধ্যমগুলো। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ফেসবুক’ এখন চাঙ্গা এই আন্দোলনের ছবি আর খবরে। বলা যায়, রাজধানীতে কী চলছে

তা বোঝার জন্য এখন সবচেয়ে বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক। এর মাধ্যমেই একদিকে চলছে আন্দোলনের কর্মসূচি ও রাজধানীর ট্রাফিক আপডেট জানিয়ে দেওয়া এবং আন্দোলনের পক্ষে সহমত ও মন্তব্য প্রকাশ; আরেকদিকে এই ইস্যুকে ঘিরে নানা বিদ্রুপে ভরে গেছে ফেসবুক হোমপেজ।

সকাল ১০টা। গুলশান-২ এ শিক্ষার্থীরা পুরো চত্বরের চারকোণে দাঁড়িয়ে আটকে দেয় গাড়ি, ঝুলিয়ে দেয় দড়ি। ওপর থেকে ছবিটা তোলার পর সেটি জনপ্রিয় হয়ে ঘুরতে থাকে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে। একসময় এর নাম ডাকা শুরু হয় ‘ভ্যাট স্কয়ার’। এখন আর আলাদা করে এ ছবির বর্ণনা দিতে হয় না। এই নতুন নামকরণের মতোই আরও অনেক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে আন্দোলনরত নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা।

ভ্যাট দাবি করায় ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ফেসবুকে পেজও খুলে ফেলা হয়েছে ‘একজন মানসিক রোগীর জন্য সাহায্যের আবেদন’ নামে। সেই পেজজুড়ে চলছে স্যাটায়ার আর ফান। আন্দোলনের সিরিয়াসনেস এতে নষ্ট হবে কিনা জানতে চাইলে একজন আন্দোলনকারী বলেন, ‘আমরা কাউকে কিছু করতে বলছি বা করাচ্ছি এমনতো না। স্বপ্রণোদিত হয়ে স্যাটায়ার করতে বেশি দেখা যাচ্ছে। আমরা কেবল সড়ক অবরোধ করে সবাইকে আমাদের অসহায়ত্ব জানাতে চাই। সেটাই করছি।’

সকাল ১১টা রাপা প্লাজার সামনে পুলিশ। শিক্ষার্থীরা ততক্ষণে রাস্তা দখলে নিয়ে ফেলেছে। চলন্ত গাড়িগুলো প্রধান সড়কে এসে যেন বিপত্তিতে না পড়ে তা সামলাতে ভীষণ ব্যস্ত ট্রাফিক পুলিশ। পুলিশে ভরে আছে ২৭ নম্বরের চত্বর। ছেলেমেয়েরা গিয়ে পুলিশের হাতে বুকে ফুল গুঁজে দিয়ে আসে। একই দৃশ্য দেখা যায় উত্তরাতেও। এরপর থেকে এসব ছবি আর পুলিশের সঙ্গে দেখা হলে কী করণীয় তা নিয়ে লেখা পোস্ট দেদারসে শেয়ার হচ্ছে ফেসবুকে।

ওয়েলকাম টু বিউটিফুল বাংলাদেশ নামে একটি পেজে প্রকাশ্যে একটি ফোন নম্বর দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে: তোমাদের যদি আইনি সহায়তা প্রয়োজন হয় তাহলে এই নম্বরে কল করো। সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্যানেল সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

রাস্তায় জলকামান। আন্দোলনকারী ছাত্রদের হাতে স্প্রে। এরমধ্যে একজন নো ভ্যাট লিখে দিল জলকামানের পেছনে। এরপর ছবি তুলে ফেসবুকে আপ করার সময় ক্যাপশনে তার দাবি, ”জলকামান এসেছে আন্দোলন ঠেকাতে, লিখে দিলাম ‘নো ভ্যাট’।” দুপুর দুইটা। মিরপুর রোড তখন পুরোটাই ছাত্রদের দখলে কোনওরকমে দফায় দফায় নানা কথা বলে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত আসতে পারলো একটি সরকারি পাজেরো। ছেলেরা বলল ঘুরে যেতে। তারপর ছেড়ে দেওয়ার আগে গ্লাসে লিখে দিলো ‘নো ভ্যাট’। কেন গাড়িতে সিএনজিতে এভাবে স্প্রে করা হচ্ছে জানতে চাইলে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বলেন, বাংলাদেশে বড়লোকেরা কর-শুল্ক ফাঁকি দেয়। অনেকে কর নেটওয়ার্কের বাইরে থেকেও কোনও ঝামেলায় পড়েন না। আর সব জোর-জারি আমাদের ওপর। আমরা আসলে কেন রাস্তায় নেমেছি সেটা জনগণকে জানানোর জন্যই সবধরনের যানবাহনে স্প্রে করে নো ভ্যাট লিখে দিচ্ছি।

ফেসবুকে এ ধরনের সূক্ষ্ম বিদ্রুপ আর তীর্যক ছবি প্রকাশ সম্পর্কে আন্দোলনরত অনেকের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে নানা ধরনের মন্তব্য। বেশিরভাগই বলেছেন, যেহেতু শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার তাই এর ওপরে ভ্যাট আরোপ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এই দাবিটি প্রকাশ করার জন্যই তারা মাঠের আন্দোলনে আছে আর নিজ নিজ পেজে শেয়ার করছে নিজস্ব ভাবনা। তবে সব ছবি ও মন্তব্য যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তাও মানতে রাজি নন তারা। এ আন্দোলনের সঙ্গে সহমত প্রকাশকারী নানা বয়স ও পেশার মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তীব্র ভাষায় ভ্যাট আরোপের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ভ্যাট আরোপকারী কর্তৃপক্ষকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছে বলেও জানান তারা।

এদের অনেকেই বলেন, যেহেতু মাঠে স্লোগান দিচ্ছে, রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে তাই তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছে না গণমাধ্যমে তাদের আন্দোলনকে কীভাবে হাজির করা হচ্ছে। এই ফাঁকে তারা ফেসবুক পেজ ঘুরে জেনে নিচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি।

এদিকে বেশ কিছুদিন আন্দোলন ও হরতালবিহীন দিন কাটানোয় রাজধানীবাসীও ছাত্র বিক্ষোভে খানিকটা দিশেহারা। অন্য সময়ের মতো যানবাহন ভাঙচুর কিংবা জানমালের নিরাপত্তাহীনতা এ আন্দোলনকে ঘিরে না থাকলেও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে কোন সড়কের অবস্থা কী রকম সেটা জেনে নিতেও অনেকে দ্বারস্থ হচ্ছেন ফেসবুকের পাতায়। এ কারণে রবিবার সারাদিন সবচেয়ে ব্যস্ত ছিলো GO! Traffic Updates (by GObd.co) নামের ফেসবুক পেইজটি। শহরের প্রধান সড়কগুলোর ট্রাফিক আপডেট জানিয়ে দেওয়া ও কিছুক্ষণ পরপর ওইসব এলাকার পরিস্থিতির ছবি প্রকাশ করে দ্রুতই এই পেইজটি অনেকের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল দিনভর।

আবার ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে ফেসবুকে যেসব পেজ ও যোগাযোগ তৈরি হয়েছে সেখানে সংহতি জানাচ্ছেন অনেকেই। তেমনই সংহতি জানাতে গিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একজন লিখছেন ‘প্রিয় শিক্ষার্থী, সুযোগ পেলে কবিতাটি আরেকবার পড়ে নাও। আগুন পাবে….। এ কবিতাটি হচ্ছে হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়: এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

এ আন্দোলনে প্রতিদিন সংহতি জানয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন চেনা-অচেনা অসংখ্য মুখ। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া আব্দু্ল্লাহ আল ক্বাফী রতন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন,’এ বছর বাজেট অধিবেশনে জবাবী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী মুহিত জানিয়েছিলেন শিক্ষা এ সরকারের প্রায়োরিটি না। সুতরাং শিক্ষা সংকোচনের জন্য নানা নীতি এ সরকার গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষা সংকোচনের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। আসুন এ বিদ্রোহের পাশে দাঁড়াই।’

ছাত্র আন্দোলনের কারণে রবিবার কোনও কোনও সড়কে যানবাহন না থাকায় ছিল পথে বেড়ানো যাত্রীদের অসহনীয় দুর্ভোগ, আবার কেউ কেউ না চাইতেই ফাঁকা রাস্তা পেয়ে মেতে ওঠেন উল্লাসে। ফেসবুকে উঠে এসেছে সে চিত্রও। সারাদিন যানবাহনহীন অবস্থায় আটকে থাকার কষ্টকেও স্যাটায়ার করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার লিখেছেন ফেসবুকে: ‘ছাত্র আন্দোলনের সুবাদে বহুদিন পরে ভ্যাটকানো হাসি মুখে লটকায় রিকশায় চড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলাম! Life is beautiful।’

সাহিত্যিক শাকুর মজিদ লিখেছেন, ‘বনানি থেকে শিল্পকলায় যাব, ২ ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরোলাম। ২২ মিনিটে পঊছে গেলাম শিল্পকলায়। এখন আমি কি করাম? ভ্যাটালাদের আন্দলোনের জয় হউক, আন্দোলনের ডরে কেউ রাস্তায় বেরোচ্ছে না, মারহাবা।’

কৃতজ্ঞতা- বাংলা ট্রিবিউন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। শুভ সকাল-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য শুভ সকাল কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।